চন্দন চৌধুরীর পাঁচটি খুদে গল্প
হাত পাতা
রাস্তাটার আইল্যান্ড বেশ বড় করে কাটা। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন পুলিশ। পুলিশ দেখেই আমার রিকশাঅলা সতর্ক হয়ে গেল। পকেট থেকে খুঁজে একটা দুই টাকার নোট বের করে নিল। বুঝতে পারলাম, আইল্যান্ডের কাটা দিয়েই সে রাস্তা ক্রস করবে। রিকশাঅলাকে দেখে একজন পুলিশ হাতটা পেছনের দিকে নিয়ে খুলে রাখল। রিকশাঅলা জাদুকরের মতো সেখানে গুঁজে দিল দুই টাকা। রিকশাঅলা হাসল, আর পুলিশও হাসল। ছেড়ে দিল রিকশাটা। একটু সামনে যেতেই জিজ্ঞেস করলাম, রিকশাঅলা ভাই, এটা কি হলো?
রিকশাঅলা আমার দিকে একটু পিছু ফিরে তাকালো। তারপর একটু ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল, ভাই, কাটা দিয়া যদি না পার হইতাম অনেকখানি পথ পার হইতে হইতো। দুই টাকাতেই মুক্তি।
আমার মুখ দিয়ে আর কথা বের হলো না। একটু সামনে যেতেই জ্যামে পড়লাম। এক ভিক্ষুক এসে বলল, স্যার, দুইটা টাকা দেন।
মানিব্যাগ খুলে দুই টাকা দিতেই রিকশাঅলা হাসল। বলল, একজন সামনের দিকে হাত পাতে, আর একজন পেছনের দিকে।
তরুণী
এক মেয়ে একজন মধ্যবয়সী লোককে বলল, জানেন, এই একটু আগেই আমি আমার পাখা হারিয়ে ফেললাম। আমি কিন্তু পরিই ছিলাম।
একথা শুনে লোকটি হাসল। বলল, হুম, এই বয়সে সবাই এ কথাই বলে।
মেয়েটা তার কথা বুঝতে চাইল না। এবার সে এক বৃদ্ধাকে এই কথা বলল। বৃদ্ধাও হাসল। বলল, একটা সময়ে আমিও এ কথাই বলেছি যে, আমিও পরি ছিলাম। এই একটু আগেই আমি আমার পাখা হারিয়ে ফেলেছি। হা হা হা…! হাসতে হাসতে চলে গেল বৃদ্ধা।
মেয়েটা বেশ বিমর্ষ হলো। দেখল, তার বয়সী একজন আসছে। এবার তাকে বলল সে কথাটি। তরুণ বলল, আসলেই তুমি পরি। মানুষ এত সুন্দরী হতে পারে না।
এবার হাসি ফুটল তরুণীর ঠোঁটে।
মৃতদের দুঃখগুলো
মৃত বাবার বুকে কান পেতে আট বছরের ছেলেটা কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছে। পাশে থাকা একজন তাকে জিজ্ঞেস করল, এভাবে কান পেতে আছিস কেন?
ছেলেটা বলল, মেঘের উড়ে যাওয়ার শব্দ শুনছি। অনেক মেঘ উড়ে যাচ্ছে।
লোকটা ভাবল, বাবার মৃত্যুশোকে ছেলেটা আবোল-তাবোল বকছে। ওঠ, ওঠ, বলে সে ছেলেটার হাত ধরল।
দাঁড়াও দাঁড়াও, বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ শুনে নিই।
মৃত মানুষের বুকে বাতাসও থাকে?
এবার ছেলেটা বলল, থাকে থাকে। বাবা বলেছে, মৃত মানুষের সব থাকে। কী থাকে না জানো? শুধু দুঃখ থাকে না। মৃত মানুষ তার দুঃখগুলো পৃথিবীতেই রেখে যায়। আর সবাই সেই দুঃখগুলো দিয়ে কাঁদে।
কবি
একজন বলল, আমার শরীরে গান ঢুকে গেছে। তার মানে এখন মানুষ থেকে পাখিতে রূপান্তরিত হচ্ছি।
একজন বলল, আমার শরীরে কান্না ঢুকে গেছে। তার মানে এখন আমি মানুষ থেকে নদীতে রূপান্তরিত হচ্ছি।
একজন বলল, আমার শরীরে একটা বোবা ঢুকে গেছে। তার মানে এখন আমি একটা গাছ হয়ে যাচ্ছি।
একজন বলল, আমার শরীরে একটা মেঘ ঢুকে গেছে। তার মানে আমি এখন আকাশ হয়ে যাচ্ছি।
একজন বলল, আমার শরীরে পিপাসা ঢুকে গেছে। তার মানে এখন আমি একটা মরুভূমি হয়ে যাচ্ছি।
এসব শুনে অন্য একজন হাসল। সবাই তার হাসির কারণ জানতে চাইল। সে বলল, আমার শরীরে এগুলোর সবই ঢুকেছিল। আমি এগুলোর প্রতিটিকে মনের বোতাম বানিয়ে নিয়েছি।
তরুণী ও নূপুরের শব্দ
নূপুরের নিক্কণ ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে, আর পরিবেশটা আনন্দঘন হয়ে উঠছিল। যে তরুণী নূপুর পরে ছিল, তার মনে হচ্ছিল যত দূর যাওয়া যায়, সেও বিস্তৃত হচ্ছে তত দূর। আর শরীর ও মন দুটোই তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। এরপর একটু আঘাত পাওয়ায় হঠাৎ থেমে গেল তরুণী। সেই নূপুরের নিক্কণও বন্ধ। তরুণী বুঝল হঠাৎ চারদিক থেকে সে কত দ্রুত গুটিয়ে গেল। তখন তরুণী বলল, তোমাকে পরে আমি উড়তে পারিনি ঠিকই, তবে মনে হচ্ছিল আমি উড়ছিলাম।
নূপুর বলল, তুমি আমার শব্দে রূপান্তরিত হতে চেয়েছিলে। তুমি আমার শব্দ হয়ে উড়ে উড়ে ছড়িয়ে পড়ছিলে চারদিকে।